কে এই আপ্তাব উদ্দিন? কি তাঁর পরিচয়? সে কথা বলার আগে যে কথাটি বলা অতীব জরুরী বলে মনেকরছি, তা হচ্ছে- সুফি কবি মাওলানা রুমি’র জন্ম না হলে যেমন শামস তাবরীজের আধ্যাত্ম দর্শন বিশ্বে প্রচার পেতো না, স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম না হলে যেমন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব অনেকের কাছে অপরিচিত থেকে যেতেন, ঠিক তেমনি ফকির আপ্তাব উদ্দিনের জন্ম না হলে সর্বধর্ম সমন্বয়বাদের প্রবক্তা, লোক সঙ্গীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, মরমি গীতিকার, কবি-মহর্ষি মনোমোহন রচিত ‘মলয়া সঙ্গীত’ এমন সুমধুর সুর তাল লয়ে সৃষ্টি হতো না। ফকির আপ্তাব উদ্দিন খাঁ একজন সুরকার। একজন গায়ক। একজন বাদক। একজন সাধক।
১৮৫৯ সালের (আনুমানিক) ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সবদর হোসেন ওরফে সদু খাঁ। মাতার নাম সুন্দরী বেগম। ৫ ভাই ১ বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বড় ভাই ছমির উদ্দিন খাঁ, ছোট ভাই বিশ্ব বিখ্যাত সুর স¤্রাট আলাউদ্দিন খাঁ, নায়েব আলী খাঁ এবং ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। তাঁর পিতা সদু খাঁ ছিলেন সঙ্গীতানুরাগী। তিনি পায়ে হেঁটে কলকাতায় গিয়ে সঙ্গীত শিখতেন। পিতার কাছেই সঙ্গীতের হাতেখড়ি। সঙ্গীত পরিবারে জন্ম নেয়া এই ক্ষণজন্মা পুরুষ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সঙ্গীত ও সুরের অনুরাগী। তিনি পল্লীগীতি এবং মুলির বাঁশিতে ছিলেন অ-সম্ভব পারদর্শী। এজন্য এলাকায় তাঁর সুনাম ছিল আকাশচুম্বী। তাঁর গান ও বাঁশির সুর বনের পাখ-পাখালীরাও মনযোগ সহকারে শুনতেন।
একবার (১৩১১ বাংলায়) পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হলে লোকের মুখে শোনাকথায় একই উপজেলার সাতমোড়া গ্রামের আধ্যাত্মিক সাধক ও মলয়া সঙ্গীতের রচয়িতা মনোমোহন দত্তের শরণাপন্ন হন এবং আরোগ্য লাভ করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মহর্ষি রচিত প্রায় সকল মলয়া সঙ্গীতেই তিনি বিভিন্ন রাগ-রাগিণী ব্যবহারে সুর করেন এবং গাইতেন। উল্লেখ্য অধিকাংশ সময়ই তিনি গাইতে-গাইতে জ্ঞান হারাতেন। অচিরেই তাঁদের যুগল বন্দি এলাকায় আলোড়ন তৈরি করে। গুরু-শিষ্যের কীর্তি দেখার জন্য অনেক দূর-দূরান্ত হতে মানুষের ঢল নামতো। তাঁরা ছিলেন হরিহর আত্মা। কথিত আছে, আপ্তাব উদ্দিন খাঁ একদিন গৃহকার্যে ব্যস্ত। কুড়াল নিয়ে কাঠ চিড়ছেন। এমন সময় হঠাৎ কুড়াল ছেড়ে দিয়ে বললেন যে তাঁকে স্মরণ করছেন সাতমোড়ার তাঁর একান্ত আপনজন। এক্ষুনি তাঁকে সেখানে যেতে হবে। তিনি ছুটলেন সাতমোড়ার আনন্দ আশ্রমের দিকে। পৌঁছে দেখলেন, মনোমোহন দত্ত একখানা সুন্দর গান রচনা করেছেন। এইমাত্র রচনা শেষ হয়েছে। সুরারোপ করার জন্য আপ্তাব উদ্দিনের কথা ভাবছিলেন আর আপ্তাব উদ্দিন তাঁর মনের সে কথা শিবপুর গ্রাম থেকে বুঝতে পেরে ছুটে এসেছেন। এমনি ছিলো দুই সাধকের মনের আকর্ষণ। গুরু মনোমোহন অনেক রাতেই প্রিয়শিষ্য আপ্তাব উদ্দিনকে বুকে নিয়ে ঘুমাতেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব নাকি প্রায়ই বলতেন, “আসলে দাদার গুরুর দোয়ার বরকতেই আমরা যা কিছু শিখেছি।”
১৩২৮ বাংলা সনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার তাঁর কন্ঠে, “মন মাঝে যেন কার ডাক শোনা যায় কে যেন আমারে, অতি সাধ করে হাত দু’খানা ধরে, কাছে টেনে নিতে চায়।” -এ গানটি শুনে জিজ্ঞাসা করলেন; এ গানের রচয়িতা কে? উত্তরে আপ্তাব উদ্দিন খাঁ বললেন; আমার গুরু মনোমোহন দত্তের। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন; কবি কল্পনা করে, সাধক চোখে দেখে’। এমন সব কালজয়ী সঙ্গীতের সুরকার তিনি। তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারে আজকাল সঙ্গীতে কতো ভাবেই না সুর হচ্ছে- অথচ ভাবতে অভাব লাগে যে, আজ থেকে শতবর্ষ আগে এই গুণী সুরকার কি চমৎকার ভাবেই না সঙ্গীতে সুর করেছেন। একটি সঙ্গীতের সুর তাল লয়ের সাথে আরেকটি সঙ্গীতের সুর তাল লয়ের কোনো মিল নেই! লোকসঙ্গীতে সাধারণত যে ধারার সুর তাল লয় ব্যবহার করা হয়, ফকির আপ্তাব উদ্দিন খাঁ দমলয়া সঙ্গীতে’ প্রচলিত সে ভাবধারার বাইরে গিয়ে সময়ের (ক্ষণ) দিক খেয়াল রেখে বিভিন্ন রাগ-রাগিণী ব্যবহার করেছেন এবং এর সাথে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সমন্বয় ঘটিয়ে মলয়া সঙ্গীতকে নিয়ে গেছেন উচ্চ থেকে উচ্চতর শিখরে। আজকের মলয়া সঙ্গীতে যে প্রাণ সে প্রাণের প্রাণপুরুষ এই ফকির আপ্তাব উদ্দিন খাঁ সাহেব। ফকির সাহেব একই সাথে তিনটি বাদ্যযন্ত্র বাঁজাতে পারতেন। তিনি স্বর সংগ্রহ, মেঘডুম্বুর ও বীনরাজ নামে তিনটি বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবণ করেন। অ-লৌকিক শক্তির অধিকারী এই সাধক একবার যা শুনতেন তা শিখে ফেলতেন। চোখ বন্ধ করে যখন তিনি সঙ্গীত সাধনা করতেন তখন আশ্রম সুরের ঝঙ্কারে মুখর হয়ে উঠতো। সুরের ভিতর দিয়েই তিনি আল্লাহর উপাসনা করতেন। মহর্ষি মনোমোহন ফকির আপ্তাব উদ্দিন খাঁকে অত্যন্ত সম্মান করতেন।
ফকির সাহেব অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপন ও গেরুয়া রঙ্গের আলখাল্লা পরিধান করতেন। তিনি তাঁর জন্মস্থান শিবপুর বাড়ির নিকটস্থ বটতলায় বসে সাধন ভজন করতেন। মানুষ তাঁকে প্রফেসর /গুণাকর বলে ডাকতেন। তিনি ছিলেন ক্ষ্যাপা। প্রচন্ড রাগী মানুষ। একবার তিনি তাঁর ছোট ভাই বিশ্ববিখ্যাত সুর স¤্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবকে ডেকে বললেন, আলম দেখি তো তুমি কি শিখেছো। এসো আমার বাঁশির সাথে তুমি তবলায় একটু সঙ্গত করো। আলাউদ্দিন খাঁ নাকি মনে মনে একটু দেমাগ পুষেছিলেন। ফকির আপ্তাব উদ্দিন তা টের পেয়ে যান। আশ্চর্য যে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ফকির সাহেবের বাঁশির সুরের সাথে তবলায় তাল মিলাতে পারছিলেন না! আপ্তাব উদ্দিন খাঁ তখন রেগে ছোট ভাই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খা’র হাতে বেত্রাঘাত করেন। কথিত আছে, আমৃত্যু আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব তাঁর ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটিতে বশ পাননি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আরেক দিকপাল নবীনগর উপজেলার শ্রীরামপুর নিবাসী ওস্তাদ গুলমোহাম্মদ খাঁ তাঁর শ্বশুর।
কমলা, চপলা ও ইন্দ্রবালা তাঁর তিন মেয়ে। ওস্তাদ ইয়াসিন খাঁ, ওস্তাদ ফুলঝুঁরি খাঁ তাঁর নাতি। মনোমোহন রচিত মলয়া সঙ্গীত জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে গুণাকর ফকির আপ্তাব উদ্দিন খাঁ’র অবদান সবচেয়ে বেশি। কেননা মলয়া সঙ্গীতে তিনি কেবল মাত্র সুরারোপই করেননি উপরন্তু তিনি তা গ্রাম-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, নগরে-বন্দরে গেয়ে গেয়ে জনপ্রিয় করে তুলেন। ফকির আপ্তাব উদ্দিন খাঁ’র মতো সঙ্গীত সাধক কালে-ভদ্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ।
১৩৪২ বাংলা সনের ১১ মাঘ তিনি দেহত্যাগ করেন।
অতীব দুঃখের বিষয়, এই গুণী মানুষটি নিয়ে উপজেলার কোথাও গড়ে ওঠেনি কোনো ভাস্কর্য-শিল্প। লেখা হয়নি তাঁর নামে কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি কিংবা রাস্তার নামকরণ।
কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।