ভারত ভ্রমণ আমার শুরু হয়েছিল অন্য অনেকেরই মতন সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের বছর ১৯৭১ সালে। ঘর-বাড়ি আপন ভূবন ছেড়ে আসা রিফ্যুইজি হয়ে। নো পাসপোর্ট নো ভিসা। তখন খুব ছোট। তৃৃতীয় শ্রেণি হতে চতুর্থ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার মতো ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউয়ের উত্তাপে উত্তপ্ত আন্দোলিত আমাদের থানা শহর নবীনগরও। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই প্রতিদিন মিছিল যায়। স্কুল থেকে কখনো কখনো আমাদেরও নিয়ে যেতো। স্লেট পেন্সিল বই খাতা নিয়ে আমরাও মিছিলে শরিক হতাম। চিকন কন্ঠে শ্লোগান দিতাম-‘জয় বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ/বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বাড়িতে ঢুকে যেতাম। ৭ই মার্চ, ১৯৭১।
রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিলেন, যে ভাষণ এখন অবিনাশী কাব্য। ২০১৭ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধু বললেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে।” তখন গ্রামের হাবাগোবা ছেলে আমরা। রেসকোর্স চিনি না, বঙ্গবন্ধুও ততোটা বুঝি না, কিন্তু শেখ চিনি, মুজিব চিনে গেছি। শেখ মুজিবের কথা শেষ কথা এটা বুঝে গেছি। মুজিব বলেছেন- যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। কী অবাক কান্ড! আমাদের ঘর বাড়ির অবস্থা পরিবর্তন হতে থাকলো। আমাদের বাড়ির সামনে গোল্লাছুট, ফুটবল খেলার মাঠ। সেখানে প্রতিদিন বিকেলে বড়দের শরীর চর্চা শুরু হয়ে গেল। বাঁশঝাড় হতে শক্ত বাঁশ কেটে লাঠি, তীর ধনুক বানানু শুরু হয়ে গেল। লোহার পরিত্যাক্ত সামগ্রী সংগ্রহ করে কামারের অগ্নি-ফাঁপরে গলিয়ে তীরের ফলা বানানো তৈরি শুরু হয়ে গেল।
শরীরচর্চা করাতেন অবসরপ্রাপ্ত একজন সেনাসদস্য। আমাদের কাজ দেয়া হলো কলসি দিয়ে টিউবওয়েল থেকে পানি এনে গ্লাস নিয়ে অপেক্ষা করা। তৃষ্ণার্ত হয়ে পানি চাইলে পানি দেয়া। ছোট আমাদের মনে যুদ্ধ বা এর ভয়াবহতা নিয়ে বিন্দুমাত্র উৎকন্ঠা নাই। একটা সাজ সাজ উৎসবের ভাব আমাদের মনে। মেশিনগান, কামান, পিস্তল এসবের তখনো নাম জানি না। বন্দুক চিনি। এটা দিয়ে পাখি শিকার করে। এতটুকুতেই ছিল আমাদের জ্ঞানের দৌড়! অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকল খুব দ্রুত। বাতাসে বারুদের গন্ধ আমরা শোঁকতে না পারলেও আশংকা সংক্রামিত হতে থাকল আমাদের মনেও। এই প্রথম বুক দুরুদুরু কী হয়! কী হয়! পশ্চিম পাকিস্তানি আর পাঞ্জাবি দুইই ভয়ানক জানোয়ার হয়ে আমাদের মানসে আঁকা হয়ে গেছে ততোদিনে।
শহর থেকে গ্রামে চলে আসতে লাগলো মানুষ। আমাদের বাড়িতেও নরসিংদী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হতে দুই আত্মীয় পরিবার এসে থাকতে লাগলো। তখনো আমাদের চিন্তাতেই নেই – কী ভয়ানক হয়ে আসছে সামনের সে দিন। কী ভয়ানক পাশবিক আক্রমণে রক্তের হোলিতে স্নাত হবে সরকারি কর্মজীবীর কর্মক্ষেত্র, ছাত্রদের আবাসিক হল, বাড়িঘর, রাজপথ। মাঠে ঘাটে ঘরে বারান্দায় রাজপথে পড়ে থাকবে আমাদেরই অগনিত মৃতদেহ! শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে আসতে থাকলো মানুষ। আমাদের স্কুল বন্ধ। চৈত্র মাসের এক রুক্ষ দুপুরে হঠাৎ চিৎকার- পাঞ্জাবি এসেছে! পাঞ্জাবি এসেছে!! নিমিষে লোকজন লাঠিসোটা, তীর-ধনুক, কুইচ-বল্লম নিয়ে দৌড় লঞ্চঘাটের দিকে। আমাদের বাড়িতেও বড় দুই দাদা কুড়াল এবং শাবল নিয়ে দে দৌড়। দেখা গেল- পাঞ্জাবি সৈন্য নয়, একজন বিহারী বা পশ্চিম পাকিস্তানিকে কোন অপরাধে ধরে নিয়ে এসেছে থানায়। এখন ভাবি, মুক্তি সংগ্রামের জন্য উন্মুখ একটি জাতি, আধুনিক অস্ত্রসস্ত্র সম্পর্কে কোন ধারণা নেই- কিন্তু শত্রæর মোকাবেলা করতে পিছু পা নয়। এলো সেই ভয়াবহ ২৫ শে মার্চের কালো রাত।
অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চললো রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। সে রাতেই তখন তারিখ ২৬ মার্চ, বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্বলিত তারবার্তা সর্বত্র বেতারযোগে পাঠাবার জন্য সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসে জনৈক অনুগতকে ডিকটেশন দিলেন। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের কাছে এ তারবার্তা যথাসময়ে পৌঁছেছিল এবং তিনি তা চট্টগ্রাম বেতার হতে প্রচার করেছিলেন। ২৬ মার্চ তারিখেই এই তারবার্তা সব জেলা প্রশাসক, মহকুমা প্রশাসক এবং সব দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে পাঠানো হয়। দলে দলে কাতারে কাতারে লোকজন সপরিবারে আসতে থাকলো গ্রামের দিকে। নবীনগরের উপর দিয়ে চললো মানুষের স্রোত। তাঁদের থাকার জন্য হাই স্কুল, গার্লসস্কুল ও কলেজে শরণার্থী শিবির ও লঙ্গরখানা খোলা হলো। আমরা ছোটদের বসিয়ে দেওয়া হলো রাস্তার মোড়ে মোড়ে। মাটির কলসিতে জল ও গুড়ের বাতাসা দিয়ে। পথশ্রান্ত ঘর ছেড়ে অনুদ্দেশ যাত্রীদের জল-বাতাসা দিয়ে তৃষ্ণা নিবারনের জন্য। সেদিন চৈত্র সংক্রান্তি। চিত্রি এবং চরলাপাং এর মাঝে জালালপুর গ্রামের কাছে মেঘনায় ছিল পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ। মুক্তিযোদ্ধারা লাপাং কবরস্থানের কাছ হতে মর্টার হতে জাহাজে শেল নিক্ষেপ করে। জাহাজ মানিকনগরের দিকে সরে যায়। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই যুদ্ধ বিমান এসে বোম্বিং শুরু করে নবীনগর এলাকায়। লাপাং গ্রামের দুদু মৌলানা ও তাঁর ভাইয়ের পরিবারের সাতজন মারা যায়।
নবীনগর শাহ্সাহেব বাড়ির জামাই আব্দু মিঞা শহীদ হন। প্রায় প্রতিবাড়িতে তখন ‘আই’ বা ‘ভি’ সেপ ট্রেঞ্চ কাটা ছিল। আমরা ট্রেঞ্চে বসে আত্মরক্ষা করি। পরদিন খুব ভোরে আমরা ছোটদের ডেকে তুলল। শুধু বললো- উঠ্ উঠ্ চল্। নিয়ে চললো নদীর ঘাটে করিমশাহ্ দরগার পাশে। সেখানে সুধিরদার বাবা তারিনী পালের নৌকা প্রস্তুত। সুরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী স্যার, বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী, তারিনীপাল ও আরও কয়েকটি পরিবারের সাথে আমরা চললাম আগরতলার দিকে। ততক্ষণে খেয়াল করলাম মা আসেনি। আমাকে বুঝানো হলো মা কয়েকদিন পরেই আসবে। সেই প্রথম বুঝলাম- প্রাণের মায়ায় ঘর বানানো হলেও কখনো কখনো সে প্রাণ বাঁচাতেই ঘর ছাড়তে হয়। নৌকা তখন কৃষ্ণনগর ছেড়ে গোসাইপুরের দিকে। তখনই আকাশে আবার এলো যুদ্ধ বিমান। শুরু হলো আবার বোম্বিং। নৌকা হতে তীরে ধান ক্ষেতের ভিতরে লুকিয়ে থাকলাম সবাই। পরে জেনেছি এ বোম্বিং-এ নবীনগর পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সোনামিয়া শহীদ হন। আকাশ হতে শত্রæবিমান সরে গেলে আবার শুরু হয় যাত্রা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখনো শত্রু হিনী মুক্ত। রসুলপুর-গোকর্ণঘাট পার হয়ে কুড়–লিয়া খালে প্রবেশ করে নৌকা। খালমুখেই মুক্তিফৌজের ঘাটি। নৌকা ভিড়িয়ে খোঁজখবর নিল। অভয় দিল এগিয়ে যেতে। কোনপথে কিভাবে যেতে হবে দিকনির্দেশনা দিল। সিএন্ডবি ব্রীজের নিচে আসতে আরেক বিপত্তি। পানি খুব কম। বড়রা নৌকা থেকে নেমে টেনে- ঠেলে নৌকা পার করলো। এরপর দীর্ঘপথ কিভাবে গিয়েছি আর মনে নেই। সন্ধ্যায় পৌঁছলাম সিঙ্গারবিল। শুরু রিফ্যুইজি জীবন।